আবারও দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় বাংলাদেশ বিমান

Passenger Voice    |    ০৯:১০ এএম, ২০২১-০৭-০৩


আবারও দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় বাংলাদেশ বিমান

ফের দুর্নীতিবাজদের আখড়ায় পরিণত হচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। নিয়োগ-পদোন্নতি, লিজ নবায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, ওভারহোলিং, জিএসএ, গ্রাউন্ড সার্ভিস, কার্গো পরিবহণ, টিকিট কেনাবেচাসহ প্রায় সব খাতেই তাদের দৌরাত্ম্য। পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে এভিয়েশন সেক্টরে অনভিজ্ঞ একাধিক কর্মকর্তাকে।

যার কারণে রাষ্ট্রীয় এই ক্যারিয়ারটি রীতিমতো বিপত্তিতে পড়েছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এভিয়েশন ব্যবসা পরিচালনার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াও কর্ম অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা খুবই জরুরি।

২০১৯ সালের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিমান মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে দুর্নীতিমুক্ত করতে ক্রাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছিল। বিমানের তৎকালীন এমডিসহ অর্ধশত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কার, ওএসডি এবং চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। একই সঙ্গে বিমানের টিকিট কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের চিহ্নিতকরণসহ পুরো দুর্নীতির প্রক্রিয়াকে নির্মূল করা হয়।

এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রতিষ্ঠানটির ওপর। মাত্র ৯ মাসে বিমান লাভ করে ৪৬০ কোটি টাকা। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে আবারও টিকিট বিক্রিতে যুক্ত করা হয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত সব সংস্থা ও এজেন্সিগুলোকে। প্রভাবশালী সেই দুর্নীতিবাজদের অনেকে বিমানের বিভিন্ন জায়গায় ফের শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-দুর্নীতিগ্রস্ত বেশির ভাগ কোম্পানির সঙ্গে বিমানের কতিপয় দুর্নীতিবাজদের পরোক্ষ শেয়ার বা মালিকানা রয়েছে। খবর দৈনিক যুগান্তর। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে বিমানের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা মার্কেটিং এন্ড সেলস, প্ল্যানিং, প্রকৌশল ও ফাইনান্স শাখায়। টিকিট বেচাকেনা নিয়ে দুর্নীতি আগের তুলনায় আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। টিকিট রিজারভেশন ও ডিস্ট্রিবিউশনের সঙ্গে যুক্ত সেই গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি অ্যামাডিউস বিমানে দুর্নীতিতে আরও পোক্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার দুর্নীতি প্রমাণিত হলেও মার্কেটিং বিভাগের বর্তমান দুই শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজশে সাবেক দুর্নীতিবাজদের অনেকে এখন এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। একই সঙ্গে লাল তালিকাভুক্ত দেশি-বিদেশি ৫৭টি ট্রাভেল এজেন্সি আরও দোর্দণ্ড প্রতাপে বিমানে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। যদিও এই ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে কয়েকশ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘জাতি এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক হবে না-এমন কোনো কিছুই তিনি করতে দেবেন না।’ বিমানে যোগদানের সময় মাত্র কয়েক মাস হয়েছে-উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা) ঘোষণা করেছে। বিমানেও এই ধাারা অব্যাহত থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘বিমানকে দুর্নীতিমুক্ত এবং লাভজনক করার জন্য তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি সেটা করার জন্য সর্বোচ্চ শ্রম দেবেন। একই সঙ্গে তিনি সংবাদমাধ্যমেও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয় এমন কিছু না লেখার অনুরোধ জানান।’

সূত্র জানায়, বিমান মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশে অ্যামাডিউস, অ্যাবাকাসসহ সবগুলো ডিজিএস কোম্পানিকে বাতিল করে বিমানের নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে টিকিট কেনাবেচার কথা ছিল। সে অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। কয়েক কোটি টাকা খরচ করে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল নির্ভুল ইন্টারনেট বুকিং ইঞ্জিন, ই-কমার্স সিস্টেম, মোবাইল অ্যাপসসহ আরও বেশ কিছু সফটওয়্যার। প্রতিষ্ঠা করা হয় বিমান হলিডেজ। যেগুলো উদ্বোধন করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রভাবশালীদের হাত এতটাই শক্তিশালী যে, এক বছরের মাথায় এরা সবকিছু নষ্ট করে দেয়।

ফের তাদের কব্জায় নিয়ে আসে মার্কেটিং অ্যান্ড সেলসসহ সব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। এ বিষয়ে খোদ বিমানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্পষ্ট বক্তব্য হলো-এয়ারলাইন্সটির শীর্ষ পদগুলোর অধিকাংশ কর্মকর্তা নন-টেকনিক্যাল হওয়ায় এরা দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, অনেক অসাধু শীর্ষ কর্তাও এই দলে নাম লিখিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নিজস্ব অনলাইন প্ল্যাটফরম থাকার পরও মার্কেটিং বিভাগের দুই শীর্ষ কর্মকর্তার অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে জিডিএসের প্রতি সেগমেন্টে ৭ থেকে ১৪ ডলার করে অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে বিমানকে।

যার কারণে অহেতুক বিমানকে প্রতি মাসে গুনতে হয় ৬ থেকে ৮ লাখ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৭ কোটি টাকা। যা বছর শেষে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। শুধু টিকিট বিক্রি নয়, কার্গো পণ্য পরিবহণেও বড় ধরনের দুর্নীতির ফাঁদ তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট এই চক্র। এ ক্ষেত্রেও ফের সাবেক দুর্নীতিবাজরা বড় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।

বিমানের যাহীবাহী উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে চারটি সুপরিসর বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই জাহাজগুলো দিয়ে কোনো যাত্রী পরিবহণ না করেও যদি শুধু কার্গো পণ্য পরিবহণ করা হতো, তাহলেও বিমান লাভের ধারায় থাকত। করোনাকালীন বাংলাদেশের বিশাল কার্গো পণ্য পরিবহণ করে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো শত শত কোটি টাকা আয় করলেও মার্কেটিং বিভাগের অদক্ষতায় বিমান এই আয় থেকেও বঞ্চিত হয়েছে।

উলটো বসিয়ে রেখে বিমানগুলোর ব্যয়বহুল ‘সি চেক’ ‘ডি চেক’ করানো হচ্ছে। পাশাপাশি গুনতে হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ও পাইলট ক্রুদের বেতন-ভাতা। একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, একটি উড়োজাহাজ হ্যাঙ্গারে বসা থাকলে প্রতি ঘণ্টায় গুনতে হয় আড়াই হাজার ডলার।

আর উড্ডয়নের জন্য ঘণ্টায় ব্যয় হয় জ্বালানিসহ ৬ হাজার ডলার। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে যে মাত্রায় কার্গো পণ্যের বাজার আছে, তাতে প্রতি মাসে বিমান শুধু কার্গো পরিবহণ করেই ৮২ কোটি টাকা আয় করতে পারত। কিন্তু কমিশন বাণিজ্য না থাকায় সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই কার্গো ব্যবসা না করে বিমানগুলোকে বসিয়ে রেখে বড় ধরনের লোকসানের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, বিমানের লন্ডন-জেদ্দা-রিয়াদসহ কয়েকটি বৈদেশিক স্টেশনের কার্গো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই এখন বিমানে বহাল-তবিয়তে। ফাইন্যান্স বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার জোগসাজশে লন্ডন স্টেশনের কার্গো খাতে ৫৪ লাখ টাকার বেশি গচ্চা দিয়েছে বিমান।

সেই টাকা এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফাইন্যান্স বিভাগের ওই কর্মকর্তার অপর এক ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিমানে চাকরি করাকালীন দুর্নীতির মাধ্যমে ৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। সেই টাকা আজও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফাইন্যান্স বিভাগের এই কর্মকর্তার অদক্ষতার কারণে করোনাকালীন বিমান কয়েকশ কোটি টাকা আদায় করতে পারেনি।

এর মধ্যে চার্টার্ড ফ্লাইটের অনাদায়ী টাকার পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার বেশি। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের কমিশন নিয়ে এই টাকা ফেলে রাখা হয়েছে। অপরদিকে এয়ারলাইন্সের প্ল্যানিং ও ফাইন্যান্স-এই দুই বিভাগের দায়িত্বে একই ব্যক্তি কর্মরত থাকায় অনিয়ম আরও বেশি জেঁকে বসেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

তারা জানান, এভিয়েশন সেক্টরে শতভাগ অনভিজ্ঞ একজন আবহাওয়াবিদকে বসানো হয়েছে বিমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যানিং ও ফাইন্যান্স বিভাগে। তিনি নিজেকে বিমান পরিচালনা পর্যদের একজন সদস্যের বন্ধু পরিচয় দিয়ে বিমানে ব্যাপক প্রভাব তৈরি করেছেন। জানা গেছে, করোনাকালীন বিমানের সব ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে বেতন-ভাতা ১০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হলেও ওই কর্মকর্তার বেতন বাড়ানো হয়েছে ৯৬ হাজার টাকা। 

যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, সেবার মান আধুনিকায়নে যে বিভাগটি কাজ করছে তার নাম গ্রাহকসেবা বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই পদে যারা কাজ করবেন তাদের এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছাড়াও কর্ম অভিজ্ঞতা এবং কর্মদক্ষতা অনেক বেশি প্রয়োজন। কিন্তু এই বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একাধিক অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে। 

বিমানের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ প্রশাসন বিভাগের একাধিক পদেও কাজ করছেন এয়ারলাইন্স সেক্টরে শতভাগ অনভিজ্ঞ একাধিক কর্মকর্তা। যার কারণে পুরো বিমানের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সম্প্রতি প্রশাসন বিভাগের ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চুক্তিভিত্তিক পাইলট নিয়োগে বড় কারসাজির অভিযোগ উঠেছে। প্রয়োজন না থাকার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চুক্তিভিত্তিক পাইলট নিয়োগ করেছে এই বিভাগ। শুধু তাই নয়, এই বিভাগের বিরুদ্ধে ১১ জন পাইলটকে (ফাস্ট অফিসার) বেতনবিহীন ছুটিতে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। এখন বিমানকে এই টাকা গুনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সম্পাদকীয় পদের একজন শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ‘লিভ উইদ্যাউট পে’ হচ্ছে একজন পাইলটের নিজস্ব অধিকার। যদি কোনো পাইলট নিজের পাওনা ছুটির অতিরিক্ত ছুটি ভোগ করতে চান সেক্ষেত্রে ওই পাইলট লিভ উইদ্যাউট পের জন্য আবেদন করতে পারেন। ম্যানেজমেন্ট কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তিবিশেষকে ‘লিভ উইদ্যাউট পে’ করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিমান প্রশাসন বিভাগের ওই শীর্ষ কর্মকর্তার একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে বিমানের ১১ জন পাইলট এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ, অপরদিকে তারা বসে থাকার কারণে লাইসেন্স হারাতে বসেছেন। তিনি বলেন, মামলা হলে বিমানকে এখন এই ১১ পাইলটের বকেয়া বেতন-ভাতা দিতে বাধ্য।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ‘লিভ উইদ্যাউট পে’ পাওয়া একজন ফাস্ট অফিসার বলেন, বিমানে বর্তমানে ৩শর বেশি পাইলট রয়েছেন। যদি করোনাভাইরাসের কারণে বিমানকে ব্যয় সংকোচন করতে হয় তাহলে সব ‘পাইলটকে লিভ উইদ্যাউট পে’ দিতে হবে। শুধু ১১ জনকে এই শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, পাইলটদের বেতন ১০ থেকে ৫০ শতাংশ কর্তন করা হয়েছে।